
ভূমিকম্পে সতর্কবার্তা কী বলছে কোরআন–হাদিস
ভূমিকম্প কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে, ভূমিকম্পের ইমানি সতর্কবার্তা, কোরআন হাদিসে ভূমিকম্পের বার্তা—এই তিনটি বিষয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, শক্তির প্রকৃত মালিক মানুষ নয়, বরং একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। মানুষ ভাবে, পৃথিবী খুব শক্ত, অটল, অনড়; অথচ আল্লাহ যখন একটি সামান্য কম্পন দেন, তখনই প্রমাণ হয়ে যায়—মানবসভ্যতা, আকাশচুম্বী দালান, প্রযুক্তি, সম্পদ—সবই এক মুহূর্তের কাঁপনে ভেঙে পড়তে পারে।
কোরআনের দৃষ্টিতে ভূমিকম্পের আসল বার্তা
কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন,
“যখন পৃথিবী তার প্রকৃত কম্পনে কেঁপে উঠবে।” (সুরা যিলযাল : ১)
এই আয়াত মূলত কিয়ামতের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা বললেও, দুনিয়ার প্রতিটি ভূমিকম্প সেই মহাদিনের ছোট্ট স্মারক—একটি ‘ডেমো’ বা আগাম সতর্কবার্তা। পরের আয়াতে আছে,
“যখন মাটি তার বোঝা বের করে দেবে।” (যিলযাল : ২)
অর্থাৎ পৃথিবীর ভেতরে যে অদৃশ্য শক্তি, লাভা, চাপ—এসব কিছুই আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের অংশ। কেবল ‘নেচার’ বা ‘প্রাকৃতিক ঘটনা’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার মতো বিষয় নয়; বরং এ সবকিছুর পেছনে আছে একজন কারিগর, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা।
অন্য আরেক আয়াতে আল্লাহ সতর্ক করে বলেন,
“তোমরা কি নিরাপদ মনে কর, আল্লাহ স্থলে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন না?” (সুরা ইসরা : ৬৮)
এই আয়াত আমাদের ভাবতে শেখায়—
আমরা কি সত্যিই নিরাপদ?
কংক্রিটের দেয়াল, অট্টালিকা, অর্থনৈতিক শক্তি—এসব কি আমাদের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা দিতে পারে? নাকি এক মুহূর্তের ভূমিকম্পে সব নিরাপত্তার মুখোশ সরে যায়?
হাদিসের আলোকে ভূমিকম্পের ইমানি সতর্কবার্তা
কোরআন হাদিসে ভূমিকম্পের বার্তা খুব স্পষ্ট। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
“যখন তোমাদের মাঝে অশ্লীলতা ও গুনাহ ছড়িয়ে পড়বে, তখন আল্লাহ তোমাদের ওপর ভূমিকম্প চাপিয়ে দেবেন।” (মুসনাদে আহমাদ : ৫৬৫১)
এখানে ভূমিকম্পকে শুধু ভূবিজ্ঞান নয়, বরং গুনাহে ডুবে যাওয়া মানবসমাজের জন্য ইমানি সতর্কবার্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে—
“তোমরা যখন ভূমিকম্প দেখবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ করো, দোয়া করো, ক্ষমা প্রার্থনা করো।” (আল-মুজামুল কাবির : ৭৫৪৬)
অর্থাৎ ভূমিকম্প দেখা মানে শুধু ভয় পাওয়া নয়; বরং ইস্তিগফার, তওবা, নামাজ ও দোয়ায় নিজেকে ঝুঁকিয়ে দেওয়া—এটাই একজন মু’মিনের জন্য সুন্নাহসুলভ প্রতিক্রিয়া।
বিজ্ঞান যা বলে, ইমান যা শিখায়
বিজ্ঞান আমাদের জানায়, পৃথিবী বিশাল কয়েকটি টেকটোনিক প্লেটের ওপর দাঁড়িয়ে। এসব প্লেট নিচে ধীরে ধীরে সরে, কখনো সংঘর্ষ হয়, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়—চাপ তৈরি হলে ভূমিকম্প হয়। মানুষ এত হিসাব-নিকাশ করেও ঠিক কোন সময়, কোথায়, কত মাত্রার কম্পন হবে, তা নির্ভুলভাবে বলতে পারে না।
কোরআন এই সীমাবদ্ধতার কথাই ইঙ্গিত করে বলেছে—
“তোমার রবের বাহিনীকে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।” (সুরা মুদ্দাসসির : ৩১)
অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ভুল নয়, কিন্তু সেটিই সবকিছু নয়। এর পেছনে আল্লাহর কুদরত, তাকদির ও নির্ধারিত নিয়ম কাজ করছে—এটাই ভূমিকম্প কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে আমাদের বড় শিক্ষা।
ভূমিকম্প থেকে ৩টি বড় শিক্ষা
১. হৃদয়ের জন্য ইমানি সতর্কবার্তা
ভূমিকম্পের কাঁপন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
মানুষের শক্তি ক্ষণস্থায়ী
আল্লাহর শক্তি চিরস্থায়ী
সেই জন্যই ভূমিকম্পের সময় সুন্নাহ হলো—
বেশি বেশি ইস্তিগফার পড়া
তওবার মাধ্যমে গুনাহ থেকে ফিরে আসা
বেশি বেশি দোয়া ও ইবাদতে মন দেওয়া
একজন মু’মিন এ সময় বলতে পারে—
“আল্লাহুম্মাগফির লনা, ইন্না কুন্না জালিমিন” — হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মাফ করুন, আমরা তো নিজেরাই নিজের ওপর জুলুম করেছি।
২. গুনাহ ও অশ্লীলতা থেকে সামাজিক তওবা
কোরআন হাদিসে ভূমিকম্পের বার্তা কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগতও—
সুদ, ঘুষ, অশ্লীলতা, অন্যায়, জুলুম, প্রতারণা
এসব যখন সমাজে স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন আল্লাহ বিভিন্নভাবে সতর্ক করেন—
কখনো বন্যা, কখনো খরা, কখনো মহামারি, কখনো ভূমিকম্পের মাধ্যমে।
এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে জাগিয়ে দেওয়ার ঘণ্টা—ঘুম ভাঙানোর সিগন্যাল, যেন মানুষ গুনাহ থেকে ফিরে আসে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
৩. দায়িত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার শিক্ষা
দুর্যোগ নেমে এলে বোঝা যায়—
মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব কতটুকু সত্যি
আমরা শুধু কথায় ‘উম্মাহ’ নাকি বাস্তবেও একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারি
হাদিসে এসেছে—
“যে তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকেন।” (মুসলিম : ২৬৯৯)
তাই ভূমিকম্পের সময় উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া, রক্তদান করা, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো—এসব শুধু মানবতা নয়, বরং ইবাদত।
ইসলামের নির্দেশ: তওবা, প্রস্তুতি ও দায়িত্বশীলতা
ইসলাম শুধু দোয়া ও তওবা শিখায় না; বাস্তব প্রস্তুতিরও নির্দেশ দেয়। আল্লাহ বলেন,
“তোমরা তাদের জন্য যা কিছু পারো, প্রস্তুতি গ্রহণ করো।” (সুরা আনফাল : ৬০)
এ আয়াতের আলোকে ভূমিকম্প কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে আমাদের করণীয় কয়েকটি দিক—
ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ
ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ম ভেঙে দুর্বল ভবন বানানো শুধু অবিবেচনা নয়
শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি ‘জান-মালের ক্ষতির কারণ সৃষ্টি’, যা গুনাহ
দুর্যোগ-পরবর্তী জরুরি করণীয়
গ্যাস ও বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করা
ফাটল ধরা ভবনে না ঢোকা
প্রতিবেশী ও দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো
রক্তদান, স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ করা
ইবাদত ও মানবতার সমন্বয়
ভূমিকম্পের সময় ও পরে বেশি বেশি দোয়া, তওবা, নামাজ ও সদকা
পাশাপাশি মানুষের প্রতি দয়া, সহমর্মিতা এবং বাস্তব সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লিখেছেন—
কোনো বিপদ কখনো কখনো মানুষের অন্তরকে এমনভাবে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়, যেমন আগুন লোহাকে নরম করে ফেলে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ভূমিকম্প কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে একজন মু’মিনের জন্য শুধু ভয় ও আতঙ্কের সংবাদ নয়; বরং তওবা, ইস্তিগফার, আত্মসমালোচনা, সামাজিক ন্যায় ও মানবিক দায়িত্ব পালনের জন্য এক বড় ইমানি সুযোগ।

