
৭৬৪ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক, ব্যাহত শিক্ষা কার্যক্রম
নেত্রকোনায় প্রধান শিক্ষক সংকট, প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিক্ষা ব্যাহত — নেত্রকোনায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষায় মারাত্মক জনবল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জেলার ১০টি উপজেলায় ৭৬৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য, যা জেলার মোট বিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি।
এতে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ও শিক্ষার মান ভয়াবহভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
জেলার শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নেত্রকোনার আয়তন ২,৮১০ বর্গকিলোমিটার। জেলার ৮৬টি ইউনিয়নে ১,৩১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
এর মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৭২ হাজার ৬২৫ জন এবং ছাত্র ১ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৬ জন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান ও সহকারী শিক্ষক মিলে অনুমোদিত পদ রয়েছে ৮ হাজার ২৩৫টি। এর মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৭ হাজার ৩৬৯ জন। প্রধান শিক্ষকের ১,৩১৩টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে দায়িত্বে আছেন মাত্র ৫৪৯ জন, ফলে ৭৬৪টি বিদ্যালয় চলছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের হাতে।
উপজেলাভিত্তিক প্রধান শিক্ষক শূন্যতার চিত্র
নেত্রকোনার ১০টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি কলমাকান্দা উপজেলায়। সেখানে ১৭২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩৩টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই।
উপজেলাভিত্তিক চিত্র:
কলমাকান্দা: ১৭২টির মধ্যে ১৩৩টি
কেন্দুয়া: ১৮২টির মধ্যে ৯৮টি
পূর্বধলা: ১৭৫টির মধ্যে ১০৮টি
সদর: ২০১টির মধ্যে ৯৩টি
আটপাড়া: ১০৩টির মধ্যে ৬০টি
দুর্গাপুর: ১২৬টির মধ্যে ৭৩টি
বারহাট্টা: ১০৯টির মধ্যে ৬৭টি
মদন: ৯৩টির মধ্যে ৬২টি
মোহনগঞ্জ: ৮৯টির মধ্যে ৪১টি
খালিয়াজুরি: ৬৩টির মধ্যে ২৯টি
অর্থাৎ, জেলাজুড়ে প্রায় প্রতি দুইটি বিদ্যালয়ের মধ্যে একটি বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকবিহীন অবস্থায় চলছে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদেও ঘাটতি
শিক্ষা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানেও দেখা দিয়েছে সংকট। জেলায় অনুমোদিত ৪৬টি উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার পদের মধ্যে ২২টি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।
এই পদগুলোতে শূন্যতা থাকায় বিদ্যালয় পরিদর্শন, শিক্ষকের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন ও প্রশাসনিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বিশেষ করে আটপাড়া, কলমাকান্দা, কেন্দুয়া, দুর্গাপুর, সদর, পূর্বধলা, মদন ও মোহনগঞ্জে এ ঘাটতি প্রকট।
শিক্ষকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, একই সঙ্গে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
একজন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন,
“প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন ছয়-সাতটি ক্লাস নিতে হয়। এতে আমাদের পক্ষে মানসম্মত পাঠদান করা সম্ভব হয় না।”
আরেকজন শিক্ষক জানান,
“প্রধান শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয়গুলোতে শৃঙ্খলা ও উপস্থিতির ওপর নজরদারি কমে গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনীহা তৈরি হচ্ছে।”
অভিভাবকদের অভিযোগ
অভিভাবকরা বলছেন, বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, শৃঙ্খলা, ও ফলাফল ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে।
কলমাকান্দার এক অভিভাবক বলেন,
“প্রধান শিক্ষক ছাড়া স্কুল মানেই অভিভাবকহীন প্রতিষ্ঠান। ক্লাস ঠিকভাবে হয় না, বইপত্রের তদারকি নেই, এমনকি মাঝেমধ্যে শিক্ষকও থাকেন না।”
প্রশাসনের বক্তব্য
মোহনগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন,
“প্রধান শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয় পরিচালনায় বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।”
কেন্দুয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আফতাব উদ্দিন জানান,
“পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে ধীরগতি এসেছে। আমরা বিষয়টি ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।”
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আজম বলেন,
“বর্তমানে ৭৬৪টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই এবং ২২ জন সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদ শূন্য। অফিস সহকারী ও হিসাবরক্ষক পদেও ঘাটতি রয়েছে। বিষয়টি আমরা বিভাগীয় উপপরিচালক ও মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। আশা করছি দ্রুত সমাধান হবে।”
সূত্র: জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দ, স্থানীয় প্রতিনিধি

