
চুরি হচ্ছে বিরল প্রাণী, পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে
প্রাণী পাচার, গাজীপুর সাফারি পার্ক, রিংটেইলড লেমুর—এই তিন শব্দেই ধরা পড়ছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর আইন-শৃঙ্খলার টানাপোড়েনে সুযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার চক্র। গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে রিংটেইলড লেমুর চুরির ঘটনার তদন্তে এমন তথ্য মিলেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর হাতে।
সিআইডির প্রাথমিক তদন্ত বলছে, পাচারকারীরা প্রথমে অনলাইনে বিরল প্রাণীর ছবি প্রচার করে ক্রেতা খুঁজে নেয়। ক্রেতা পছন্দ করলে প্রাণী চুরি করে সরবরাহ দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রাইভেট গ্রুপ, ইনবক্স লেনদেন এবং হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে হয় এই ব্যবসা।
গাজীপুর সাফারি পার্কে রিংটেইলড লেমুর চুরির ঘটনা
২০১৮ সালে মাদাগাস্কার থেকে রিংটেইলড লেমুরসহ ৮৬ জোড়া প্রাণী আমদানি করা হয়। পরে এসব প্রাণী রাখা হয় গাজীপুর সাফারি পার্কে। কয়েক বছরেই লেমুরের সংখ্যা বেড়ে হয় চারটি।
কিন্তু গত ২৩ মার্চ রাতেই নিরাপত্তাবেষ্টনী কেটে চুরি হয় দুটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী লেমুর। এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তে উঠে আসে, পার্কের আউটসোর্সিং কর্মী নিপেল মাহমুদ এই চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
নিপেল পার্কের ভেতরে প্রাণীর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতেন। আগ্রহী ক্রেতা পাওয়া গেলে তিনি বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেনদেন সম্পন্ন করতেন।
২৩ মার্চ ভোরে চুরি হওয়া তিনটি লেমুর তিনি প্রতিবেশী জুয়েল মিয়ার বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। পরে একটিকে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। বাকি দুইটি লেমুর ৭ লাখ টাকায় ভারতীয় ক্রেতার কাছে বিক্রির জন্য পাঠান দেলোয়ার হোসেন তাওসীফ ও সাব্বির হোসেন তপন।
চুরির কমিশন হিসেবে নিপেল পান ৭০ হাজার টাকা।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীমউদ্দিন জানান,
“নিপেল মাহমুদ আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী চক্রের সক্রিয় সদস্য। পার্কের ভেতরে কাজ করার সুযোগে তিনি বিরল প্রজাতির প্রাণীর ছবি সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির চেষ্টা করতেন।”
আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচারের রুট উন্মোচিত
সিআইডি সূত্র বলছে, চুরি করা প্রাণীগুলো প্রথমে দেশের সীমান্ত এলাকায় ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও বুড়িমারী সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর পাচারকারীরা সেগুলো ভারত, মিয়ানমার বা নেপাল হয়ে চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে পাঠায়।
এখানে শুধু জীবিত প্রাণী নয়— পাচার হয় কচ্ছপের খোলস, হাঙরের চর্বি, বনরুইয়ের আঁশ ও নীলগাইয়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪,০৪৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
৪৫৮টি কচ্ছপ,
১,০৪৪টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি,
৯৭৮টি সরীসৃপ,
৮৫৬টি বানর, তক্ষক ও অন্যান্য প্রাণী।
এছাড়া কয়েকটি ঘটনায় হাতির দাঁত, হাঙরের চর্বি, নীলগাইয়ের হাড় ও বন্যপ্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্ধার করা হয়েছে।
সীমান্তপথে পাচারের ঘাঁটি
পাচারকারীরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কয়েকটি এলাকা ব্যবহার করছে, যেমন—
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, দিনাজপুরের হিলি, মেহেরপুর ও বুড়িমারী।
২০২২ সালে ভারতের জলপাইগুড়ির গজলডোবায় উদ্ধার হওয়া সাতটি ক্যাঙ্গারু বাংলাদেশ হয়ে প্রবেশ করেছিল, এমন দাবি করেছিল ভারতের গণমাধ্যম। এর আগেও ঠাকুরগাঁওয়ে উদ্ধার হয় একটি নীলগাই, যা ১৯৪০ সালের পর বাংলাদেশে দেখা যায়নি।
পাচার চক্রের ধরন ও আর্থিক দিক
প্রাণী পাচারে মূলত তিন স্তরের চক্র কাজ করে—
তথ্যদাতা ও সংগ্রাহক: যারা পার্ক, চিড়িয়াখানা বা জঙ্গলের প্রাণীর তথ্য দেয়।
চোরাকারবারি দল: যারা চুরি ও পরিবহন করে।
মধ্যস্থ ও ক্রেতা নেটওয়ার্ক: যারা প্রাণী বিক্রি করে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে।
একটি বিরল লেমুর বা বনরুইয়ের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে।
সিআইডির অগ্রগতি ও পরবর্তী পদক্ষেপ
সিআইডি জানায়, গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে চুরি হওয়া তিনটি লেমুরের মধ্যে একটি উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি দুটি উদ্ধারে অভিযান চলছে। এ ঘটনায় ছয়জন পাচারকারী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটও বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুক ও টেলিগ্রাম গ্রুপ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক প্রাণী পাচার বেড়েছে, যা এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ।
প্রাণী পাচার রোধে করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে,
সাফারি পার্ক ও চিড়িয়াখানায় ডিজিটাল মনিটরিং ও সিসিটিভি নজরদারি বাড়ানো,
সীমান্ত এলাকায় ড্রোন নজরদারি ও কাস্টমস স্ক্যানার জোরদার,
পাচারকারীদের জন্য কঠোর সাজা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি— এই তিন পদক্ষেপ জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান বলেন,
“বন্যপ্রাণী পাচার শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি আমাদের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রতিটি প্রাণীর হার মানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া।”
সূত্র: বণিক বার্তা, সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট

