মর্যাদাহীনতায় ভুগছেন শিক্ষকরা, বাড়ছে লাঞ্ছনা ও হেনস্তা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের প্রতি লাঞ্ছনা ও হেনস্তার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মারধর ও অপমান করে চেয়ার থেকে টেনে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও ছাত্র সমন্বয়করা শিক্ষকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন, তবে পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, “শিক্ষকদের মর্যাদা দিন দিন কমছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা এখনও তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় আছেন, এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকরা কম বেতন পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, এবং নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোনো বেতনই পান না।” এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৪’, যার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ইউনেসকো, ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) জানায়, ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অন্তত ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক নেই। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। ঢাকার গুলশান মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তফা জামান মিয়া জানান, চারজন শিক্ষক তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করেন। নিউ মডেল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আ স ম ফিরোজ অভিযোগ করেন, একটি সশস্ত্র দল তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং তাঁর বাসার তালা ভেঙে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, “শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা ও হেনস্তার ঘটনা শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা নষ্ট করছে এবং এটি কখনো কখনো ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এসব ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে গবেষণার উল্লেখ করে দেখা যায়, অনেক দেশে শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেশি। যেমন চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে, যেখানে আন্তর্জাতিক গড় মাত্র ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন সংক্রান্ত বিষয়ে বৈষম্য রয়ে গেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর সুপারিশ করা হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে দশম গ্রেডের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। সমন্বয় পরিষদের নেতা মু. মাহবুবুর রহমান বলেন, “অষ্টম শ্রেণি পাস গাড়িচালকরা ১২তম গ্রেডে বেতন পান, অথচ আমাদের শিক্ষকদের বেতন ১৩তম গ্রেডে দেওয়া হয়। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেবে।”
শিক্ষকদের মান-মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তাঁদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।