বিজয়ের আনন্দকে মলিন করেছিল একাত্তরের যে ঘটনা
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়, এবং সেদিন বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী যখন ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন, তখন শহর জুড়ে হাজার হাজার মানুষের আনন্দ মিছিল ছিল। কিন্তু বিজয়ের ২৪ ঘণ্টা পর জানা যায় যে, পাকিস্তানি সেনারা এক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, যা জাতির বিজয়ের আনন্দকে বিষাদে পরিণত করেছিল।
১৭ই ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একের পর এক নিহত বুদ্ধিজীবীর মরদেহের খবর প্রকাশ হতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ শত শত বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করে। দৈনিক ইত্তেফাক এই ঘটনাকে “মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড” বলে বর্ণনা করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে মোট ১,১০০ জনের বেশি বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ঢাকায় প্রায় দেড়শ জন নিহত হয়। তাদের অধিকাংশের মরদেহ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। ১৭ই ডিসেম্বর এই বধ্যভূমি থেকে প্রথম কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন গণিতজ্ঞ ড. আবুল কালাম আজাদ, ইতিহাসবিদ ড. আবুল খায়ের, এবং চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বী।
মরদেহগুলো ছিল অত্যন্ত বিভৎস অবস্থায়। অনেকের চোখ উপড়ানো, পেছনে হাত বাঁধা, এবং বুক ও মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল। এর মধ্যে কিছু মরদেহ শকুন ও কুকুরের খাদ্য হয়ে গিয়েছিল। ১৯ই ডিসেম্বর প্রকাশিত খবরে জানানো হয় যে, মরদেহগুলো সনাক্ত করা এতটা কঠিন ছিল যে, অনেক আত্মীয় স্বজনও মৃতদেহ চিনতে পারছিলেন না।
সরকার পরবর্তী সময়ে জানায়, পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান এবং জামাতে ইসলামীর আল বদর বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। সেই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে থাকা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদেরও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল, তবে তারা বুদ্ধিমত্তার কারণে বেঁচে যান।
এই হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়, যা স্বাধীনতার আনন্দকে চিরকাল মলিন করে রেখেছে।