বাংলার ঘরে শতবর্ষী সাধনায় পঞ্জিকার পদচিহ্ন

বাংলার ঘরে শতবর্ষী সাধনায় পঞ্জিকার পদচিহ্ন

নববর্ষ মানেই নতুন পঞ্জিকা—পাতলা কাগজে ছোট হরফে ছাপা, খয়েরি বা গোলাপি মলাটে বাঁধা এই বইটি বৈশাখের আগে বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে নিঃশব্দে। বার-তিথি-নক্ষত্র-যোগ আর করণের খুঁটিনাটি জানিয়ে দেয়ার পাশাপাশি একাদশী, অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার দিনক্ষণও জানিয়ে দেয় এই ক্ষুদ্র বই। শতবর্ষ ধরে এই পঞ্জিকার আদলে বাংলাভাষীদের জীবনে জায়গা করে নিয়েছে ‘সাধনা ঔষধালয়’ প্রকাশিত বাংলা ক্যালেন্ডার।

শুধু সময় জানানোর মাধ্যম নয়, বরং কৃষকের জন্য এটি চাষাবাদের দিন ঠিক করে দেয়, জেলের জন্য নির্ধারণ করে সাগরে যাওয়ার সঠিক মুহূর্ত।
১৯১৪ সালে ঢাকার সূত্রাপুরে যোগেশচন্দ্র ঘোষের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাধনা ঔষধালয়’। প্রতিষ্ঠানটি আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতের পাশাপাশি পঞ্জিকা-ভিত্তিক বাংলা ক্যালেন্ডার ছাপা শুরু করে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

সাধনা ঔষধালয়ের বরিশাল শাখার পরিচালক রণজিৎ কুমার সেনগুপ্ত জানান, শতবর্ষের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা হয়েছে আন্তরিকতা ও আস্থার ভিত্তিতে। তিনি বলেন, “পঞ্জিকার জটিলতা বোঝা সাধারণ মানুষের জন্য সময়সাপেক্ষ, অথচ আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার সে অভাব পূরণ করে চলেছে।”

বরিশালের ব্যবসায়ী বলরাম ঘোষ জানান, “সাধনার ক্যালেন্ডারেই এখন পঞ্জিকার অনেক তথ্য পাওয়া যায়, তাই চাহিদাও রয়েছে বেশ। হালখাতার মৌসুমে এটি বেশ বিক্রি হয়।”
কৃষক আসাদুজ্জামান জানান, “আমাদের জমিতে কী চাষ করব, কখন করব—সব দেখে নিই ওই ক্যালেন্ডার থেকে। আমার দাদাও একইভাবে চলতেন।”

বঙ্গোপসাগরের পাথরঘাটার জেলে জাকির হোসেন বলেন, “মাছ ধরার ‘গোন’ আমরা পঞ্জিকার ভাষা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু সাধনার ক্যালেন্ডারে সহজভাবে লেখা থাকে। তাই সেটাই দেখেই সাগরে যাই।”

প্রবীণ সাংবাদিক আনিচুর রহমান খান স্বপন বলেন, “আগে ক্যালেন্ডার নিয়ে কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা ছিল। এখন তো মোবাইলই তাদের সব কিছু। বাংলা ক্যালেন্ডার যেন স্মৃতির জিনিস হয়ে উঠেছে।”

চারুকলা বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশান্ত ঘোষের মতে, “দেওয়ালে এখন সত্যজিৎ রায়ের পোস্টার ঝুললেও ক্যালেন্ডার ঝুলে না। নতুন প্রজন্ম শারদীয় ছুটির দিন জানে ঠিকই, কিন্তু নীল ষষ্ঠীর উপোস কবে—সে খোঁজ রাখে না।”

তবে সব অভিমান সত্ত্বেও বাংলার আদি সংস্কৃতির নিঃশব্দ বাহক হয়ে আজও বাংলা ক্যালেন্ডার দাঁড়িয়ে আছে সাধনার মতো কিছু প্রতিষ্ঠান ও মানুষের হাতে—যারা শুধু সময় নয়, সংযম ও সংস্কারের বার্তাও পৌঁছে দেন প্রতিটি পাতায়।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS Wordpress (0) Disqus ( )