নিষিদ্ধ ঘন চিনি আমদানি, চলে ‘গোপনে’ বিক্রি

নিষিদ্ধ ঘন চিনি আমদানি, চলে ‘গোপনে’ বিক্রি

57 / 100 SEO Score

আমদানি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘন চিনি, নিষিদ্ধ মিষ্টি, সোডিয়াম সাইক্লামেট এখনো চট্টগ্রামের গোপন বাজারে হাতবদল হচ্ছে—প্রকাশ্যে নয়, পরিচিত ক্রেতার সামনে আড়ালেই চলে এই বেচাকেনা। ভুয়া ঘোষণা ব্যবহার করে বন্দর দিয়ে আনা এসব কৃত্রিম মিষ্টিকারক দেশের বিভিন্ন খাদ্য কারখানায় চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলছে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানায়, গতকাল বুধবারও চট্টগ্রাম বন্দরে এক চালান থেকে চার টনের বেশি ঘন চিনি জব্দ করা হয়েছে। এর আগে মাত্র তিন মাসে তিনটি আলাদা চালানে প্রায় ১০৪ টন ঘন চিনি আটক করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজস্ব কর্তৃপক্ষের এই জব্দ অভিযান প্রমাণ করছে—নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বাজারে পণ্যটির প্রবাহ এখনো বন্ধ হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যে, সাধারণ চিনির তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি এই কৃত্রিম মিষ্টিকারক ঘন চিনি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, আইসক্রিম, জুস, চকলেট, কনডেন্সড মিল্ক এমনকি কিছু শিশুখাদ্য তৈরিতেও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কম খরচে বেশি মুনাফার আশায় সাধারণ চিনির পরিবর্তে এই ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করছেন। গবেষণা বলছে, ঘন চিনির দীর্ঘমেয়াদি সেবনে ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের জটিল রোগসহ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

গোপনে চলছে ‘স্যাকারিন’ ব্যবসা

চট্টগ্রামে এই ঘন চিনি বেশি পরিচিত ‘স্যাকারিন’ নামে। যদিও স্যাকারিন ও সোডিয়াম সাইক্লামেট আলাদা রাসায়নিক উপাদান, স্থানীয় বাজারের বাস্তবতায় ঘন চিনিকেই স্যাকারিন নামে বিক্রি করা হয় বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। একসময় খাতুনগঞ্জের মসলার দোকানগুলোতে প্রকাশ্যেই স্যাকারিন বিক্রি হতো। কয়েক বছর আগে ভোক্তা অধিকার ও প্রশাসনের অভিযানের পর ফ্রন্ট কাউন্টার থেকে তা সরিয়ে নেওয়া হলেও পণ্যটির গোপন বেচাকেনা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও আছদগঞ্জের প্রায় ৩০টি মসলার দোকানে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে—বেশিরভাগ দোকানি প্রকাশ্যে স্যাকারিন বিক্রির কথা অস্বীকার করছেন। তবে অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, পরিচিত ক্রেতাদের জন্য এখনো স্যাকারিন বা ঘন চিনি আড়ালে রাখা থাকে। তাঁদের ভাষ্যমতে, প্রতি ১০০ গ্রাম স্যাকারিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। অনলাইনে ফুড গ্রেড নামে ৫০ গ্রাম স্যাকারিন ১১০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।

দুই ব্যবসায়ী সমিতির কয়েকজন নেতা জানান, কাস্টমস ও ভোক্তা অধিকারের সাম্প্রতিক জব্দ অভিযানের পর কেউ আর কাউন্টার সামনে পণ্য দেখান না। আগে যেভাবে খোলা বাজারে বিক্রি হতো, এখন সে রকম নয়; বিশেষ ক্রেতা ছাড়া কেউ কথা বললে তারা ‘স্যাকারিন’ থাকার কথাই অস্বীকার করেন।

দীর্ঘদিনের ব্যবহার, কম তদারকি

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে ঘন চিনির ব্যবহার নতুন নয়। বহু বছর ধরে কিছু কারখানা ও মিষ্টির দোকানে আড়ালে এ পণ্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে জোরালো তদারকি খুব কম হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য–কর্মীরা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন,

“আমরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ পেয়েছি এবং সেগুলো ভিত্তিতে অভিযান চালাচ্ছি। তবে সরাসরি কারখানায় গিয়ে এখন পর্যন্ত ঘন চিনি হাতে পাইনি। অভিযোগ থাকলেও প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন।”

প্রায় আড়াই বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের সাগরিকা এলাকায় একটি আইসক্রিম কারখানায় ঘন চিনি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করা হয়েছিল। এরপরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘন চিনি ব্যবহারের তথ্য পৌঁছালেও অনেক ক্ষেত্রেই তা অভিযানে ধরা পড়ে না।

‘স্যাকারিন’ আর ‘ঘন চিনি’—দু’টিতেই ঝুঁকি

চিকিৎসক ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মতে, সোডিয়াম সাইক্লামেটভিত্তিক ঘন চিনি পুরোপুরি স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ এবং দেশে এটি নিষিদ্ধ। অন্যদিকে স্যাকারিন নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ব্যবহার অনুমোদিত হলেও অতিরিক্ত সেবনে তা কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন,

“স্যাকারিন অতিমাত্রায় ও দীর্ঘদিন সেবন করলে কিডনির মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। আর সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘন চিনি সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এর ব্যবহারই করা উচিত নয়।”

বিএসটিআই চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক (সিএম) মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন,

“স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘন চিনি দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। খাদ্যপণ্যে এটি মেশানোর কোনো অনুমতি নেই। ধরা পড়লেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।”

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক কিছু গবেষণায় সোডিয়াম সাইক্লামেটের দীর্ঘমেয়াদি সেবনে ক্যানসার, ক্রোমোজোম পরিবর্তন, হাড়ের কোষের ক্ষতি, প্রজনন সমস্যাসহ নানা জটিলতার ইঙ্গিত মিলেছে। অন্যদিকে স্যাকারিন বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, স্থূলতা, দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রবণতা এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চট্টগ্রামের নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম বলেন,

“শীতকালে আইসক্রিম উৎপাদন তুলনামূলক কম থাকে, তাই ঘন চিনির ব্যবহারও কম থাকে বলে ধারণা করা হয়। তবে মিষ্টির কারখানা থেকে বিএসটিআই ও আমরা দু’জনেই নমুনা সংগ্রহ করতে পারি। কারণ শিরার মধ্যে মিশিয়ে দিলে খালি চোখে চিনি, ঘন চিনি আর স্যাকারিন আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।”

কঠোর নজরদারি ও সচেতনতার দাবি

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু আমদানি পর্যায়ে কাস্টমসের জব্দ অভিযান যথেষ্ট নয়। খাদ্য কারখানা, মিষ্টির দোকান, আইসক্রিম–জুস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, পাইকারি বাজার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—সব ক’টি স্তরে সমন্বিত তদারকি জোরদার করা জরুরি।

জনস্বাস্থ্য–কর্মীরা বলছেন, ভোক্তাদের সচেতনতা না বাড়ালে নিষিদ্ধ এই ঘন চিনি ও নিষিদ্ধ মিষ্টি ব্যবহার পুরোপুরি ঠেকানো কঠিন হবে। পণ্যের লেবেলে উপাদানের নাম স্পষ্টভাবে না লেখা, কাঁচামালের উৎস গোপন রাখা ও ব্যাচভিত্তিক মান নিয়ন্ত্রণের অভাব সাধারণ মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

তাঁদের দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে কঠোর অভিযান, নমুনা পরীক্ষা, লেবেলিং–বাধ্যবাধকতা ও অনলাইন বিক্রিসহ সব চ্যানেলে ঘন চিনির ব্যবহার বন্ধে শক্ত আইন প্রয়োগ করতে হবে—অন্যথায় স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।

যদি চাও, এই নিউজটার জন্য আলাদা ফেসবুক ক্যাপশন/পোস্ট আর থাম্বনেইল টেক্সটও বানিয়ে দিতে পারি, পুরো প্যাকেজ হয়ে যাবে প্রকাশের জন্য

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )