
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ও ভূমিকম্প সহনীয় পরিকল্পনা
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা, ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনা, চট্টগ্রাম ভূমিকম্প ঝুঁকি—এই তিন দিক বিবেচনায় চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রায় না নিলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম নগরের লালখানবাজারে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে (আইইবি) আয়োজিত এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নৌ ঘাঁটি, ইস্টার্ন রিফাইনারি, সার কারখানা, কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছাড়াও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পুরোনো স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতা অবিলম্বে যাচাই করা প্রয়োজন।
আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মানজারে খোরশেদ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর, ইস্টার্ন রিফাইনারি, সারকারখানাসহ বেশির ভাগ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কর্ণফুলীর তীরের বেলে মাটির ওপর নির্মিত। ভূমিকম্পের সময় এ ধরনের বেলে মাটি তুষের মতো নড়বড়ে হয়ে যায়, ফলে স্থাপনাগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে।
ড. জাহাঙ্গীর আলম আরো জানান, চট্টগ্রাম নগরের প্রায় চার লাখ ভবনের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ভবনই নির্মাণ ত্রুটি ও নকশাগত দুর্বলতার কারণে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, এসব ভবনের সক্ষমতা যাচাই করে শক্তি বৃদ্ধি না করলে বড় ধরনের প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সাম্প্রতিক ২১ নভেম্বরের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপত্তিস্থল হওয়া ওই ভূমিকম্পে সেখানে বড় কোনো স্থাপনা না থাকায় ক্ষতি হয়নি; কিন্তু তার অদূরের ঢাকা শহর কম্পনে বেশি প্রভাবিত হয়। তিনি মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড এখন অকার্যকর; সবারই ২০২০ সালের হালনাগাদ বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে অনুসরণ করা জরুরি।
বক্তারা বলেন, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো; কারণ এ সময়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় লাখো শিক্ষার্থী অবস্থান করে। তাই ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে বিদ্যমান ভবনের কাঠামোগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাবে। একই সময়ে অফিস-আদালতে থাকা কর্মক্ষম মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিও জরুরি বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।
ইউরেশিয়ান প্লেটের সন্নিকটে থাকার কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল উল্লেখ করে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে চলমান ও ভবিষ্যৎ সব স্থাপনায় বিল্ডিং কোড শতভাগ মানা না হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হবে। পাশাপাশি পর্যটন শহর কক্সবাজারের উচ্চ ভবন ও হোটেল-মোটেলগুলোও কঠোর তদারকির আওতায় আনার তাগিদ দেন তিনি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার প্রযুক্তি দেশে দ্রুত স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় তিনটি বড় ফল্ট লাইন রয়েছে; সিলেটের ডাউকি ও টাঙ্গাইলের মধুপুরেও রয়েছে সক্রিয় প্লেট। এসব অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তি বসালে অন্তত আগাম সতর্কতা পাওয়া যাবে, ফলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো সম্ভব।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন চুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. মাহমুদ আব্দুল মতিন, সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম, সিএমএমইজে সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, অ্যাবের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী সেলিম মো. জানে আলম, সিডিএ ও চসিকের প্রধান প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আইইবির আজীবন সদস্য প্রকৌশলীরা। সেমিনার সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রের সেক্রেটারি প্রকৌশলী খান মো. আমিনুর রহমান।

