
ইন্দোনেশিয়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৪ লাখ মানুষ, মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়াল
ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ বন্যা, ইন্দোনেশিয়া বন্যা মৃত্যুহার, মালাক্কা প্রণালির ঘূর্ণিঝড় বন্যা—এই তিনটি অভিঘাতে দেশটির অন্তত ১৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫০০ ছাড়িয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত আরও ৫০০ জন; ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশগুলোতে উদ্ধারকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন।
দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানায়, মালাক্কা প্রণালিতে সৃষ্ট একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আচেহ, উত্তর সুমাত্রা ও পশ্চিম সুমাত্রা—এই তিন প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। হাজারো মানুষ এখনো খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও জরুরি সরঞ্জাম ছাড়া বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছেন; অনেক এলাকায় পৌঁছাতেই পারছেন না সহায়তাকর্মীরা।
আচেহর পিদিয় জয়ার বাসিন্দা আরিনি আমালিয়া বিবিসিকে বলেন, ‘পানি যেন সুনামির মতো এক সঙ্গে উঠে এসেছে। আমার দাদির বয়স হয়েছে অনেক; তার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় দুর্যোগ এটি।’
বন্যায় বহু সেতু ভেঙে পড়েছে, ভূমিধসে বন্ধ হয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। বড় যানবাহন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ায় উদ্ধারকর্মীদের হেঁটে কিংবা মোটরসাইকেলে করে দুর্গম এলাকাগুলোতে পৌঁছাতে হচ্ছে। অনেক স্থানে এখনো কোনো ধরনের ত্রাণ পৌঁছায়নি।
পশ্চিম সুমাত্রার বিখ্যাত টুইন ব্রিজ এলাকার মাটি–কাদার স্তূপ সরাতে নিরলস কাজ করছে প্রশাসন। সেখানে নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে অপেক্ষায় আছেন মারিয়ানা নামের এক নারী। তিনি বলেন, ‘খননযন্ত্রের বালচাল যখন ঘন কাদা তুলে ফেলে, প্রতিবারই মনে হয়—ওখানেই কি আমার ছেলের নিথর দেহ? তাকে আদৌ চিনতে পারব তো?’
উত্তর সুমাত্রার সেন্ট্রাল তাপানুলির বাসিন্দা মাইসান্তি জানান, তিন দিন ধরে তাদের এলাকার মানুষের কাছে পর্যাপ্ত খাবার নেই। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ইনস্ট্যান্ট নুডুলস নিয়েও মানুষের মধ্যে ঝগড়া বাধছে। আমরা এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি—খাবার নেই, পানি নেই।’
বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় ইন্টারনেট ও ফোনসেবাও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অনেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে নেটওয়ার্কের সিগন্যাল খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। সেন্ট্রাল আচেহতে রোববার রাতে হাজারো মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে স্টারলিংক ডিভাইসের মাধ্যমে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।
উদ্ধার ও ত্রাণকাজ চললেও সরকারের প্রস্তুতি ও সাড়াদানে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। অভিযোগ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সমন্বয়ের দুর্বলতার কারণে যথাসময়ে খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে।
সোমবার উত্তর সুমাত্রার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো স্বীকার করেছেন, বহু রাস্তা এখনো বিচ্ছিন্ন; তবু তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমাদের জাতি দৃঢ়চেতা; ইনশাল্লাহ, আমরা এই সংকট পার হয়ে যাব।’
শুধু ইন্দোনেশিয়াই নয়, গত এক সপ্তাহে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকাসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বন্যা ও ভূমিধসে প্রায় ১১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীলংকায় ৩৫৫ জন এবং থাইল্যান্ডে ১৭৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
বিবিসি ওয়েদারের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এটি একক কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব নয়; উত্তর–পূর্ব মৌসুমি বায়ু, ঘূর্ণিঝড় এবং অতিরিক্ত আর্দ্রতা—এই তিনের সম্মিলিত প্রভাবে এ অঞ্চলে অস্বাভাবিকভাবে বৃষ্টিপাত বেড়ে গেছে। শ্রীলংকায় বৃষ্টিপাত বাড়িয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘দিতওয়া’, আর মালয় উপদ্বীপ–সুমাত্রা অঞ্চলে ‘সেনিয়া’ নামের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এক মিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, বিষুবরেখার এত কাছাকাছি এভাবে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক; জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন যে সরাসরি দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ বন্যা তারই করুণ উদাহরণ।

